হেফাজতের ঢাকা অবরোধের ৫ বছর, কেবল একটি মামলার বিচার হয়েছে

hqdefault.jpg

১৩ দফা দাবিতে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ ২০১৩ সালের ৫ মে ঢাকা অবরোধ করে এবং রাজধানীতে ব্যাপক তাণ্ডব চালান হেফাজতের কর্মীরা। পরদিনও দেশের বিভিন্ন স্থানে তাণ্ডব চলে। ওই তাণ্ডবের ঘটনায় করা সারা দেশে যে ৮৩টি মামলা হয়েছে, তার মধ্যে ৬২ টির তদন্ত থেমে আছে গত পাঁচ বছর। সরকারের সিদ্ধান্ত না পাওয়ায় পুলিশ এসব মামলার কোনো তদন্তই করছে না বলে জানা গেছে।

তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, তাঁরা মনে করছেন, সরকারের সঙ্গে হেফাজতের সমঝোতার কারণে এসব মামলার আপাতত তদন্ত হবে না। আর তদন্ত হলেও এতে হেফাজতের কর্মীদের জড়ানোর কোনো কারণ নেই। হেফাজত নেতারাও বলেছেন, তাঁদের সঙ্গে সরকারের যে কথা হয়েছে, তাতে সরকার এসব মামলা প্রত্যাহার করে নেবে। এ নিয়ে এখন আলোচনা চলছে।

মামলার তদন্ত থেমে থাকার ব্যাপারে জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের গণমাধ্যম বিভাগের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) আবদুল আলীম মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, এসব মামলার অনেক আসামি জামিনে আছেন। তদন্ত শেষে মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া হবে। আসামির সংখ্যা বেশি, এ কারণে দেরি হচ্ছে। তদন্ত থেমে নেই বলে তিনি দাবি করেন।

হেফাজতের তাণ্ডবের ঘটনায় সারা দেশে মামলা হয় ৮৩ টি। এর মধ্যে কেবল বাগেরহাটের একটির বিচার শেষ হয়েছে। রায়ে সব আসামি খালাস পান। দুটি মামলার অভিযোগ প্রমাণ করতে না পেরে পুলিশ চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়ে শেষ করে দিয়েছে। বাকি ১৮টি মামলার অভিযোগপত্র দায়ের হলেও বিচার শুরু হয়নি এত বছরেও। কবে বিচার শুরু হবে, সেটাও কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারছে না।

২০১৩ সালের শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন চলাকালে কথিত নাস্তিক ব্লগারদের শাস্তিসহ ১৩ দফা দাবিতে হঠাৎ সক্রিয় হয়ে উঠেছিল কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম। তারা ওই বছরের ৫ মে ঢাকার ছয়টি প্রবেশমুখে অবরোধ করে। পরে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে অবস্থান নেয়। এ সময় হেফাজতের বিপুলসংখ্যক কর্মী-সমর্থক বিভিন্ন স্থানে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। তারা রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে শত শত যানবাহন ভাঙচুর করে এবং বিভিন্ন স্থাপনায় আগুন ধরিয়ে দেয়। এসব সহিংস ঘটনায় হেফাজতের ২২ কর্মীসহ ৩৯ জন নিহত হন। আজ সেই ভয়াবহ ঘটনার পাঁচ বছর পূর্ণ হচ্ছে।

হেফাজতের বিভিন্ন দাবির ব্যাপারে এখন সরকারের নমনীয়তা নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। তাদের দাবির মুখে কওমি মাদ্রাসার সর্বোচ্চ স্তর দাওরায়ে হাদিসকে স্নাতকোত্তর (ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবি) সমমান বলে স্বীকৃতি দিয়েছে সরকার। হেফাজতের দাবি অনুযায়ী পাঠ্যবইয়ে পরিবর্তন আনা হয়।

৫ মে তাণ্ডবের পর ঢাকাসহ সাত জেলায় ৮৩টি মামলা হয়। এসব মামলায় ৩ হাজার ৪১৬ জনের নামসহ ৮৪ হাজার ৯৭৬ জনকে আসামি করা হয়। তবে হেফাজতের আমির শাহ আহমদ শফীকে কোনো মামলাতেই আসামি করা হয়নি। হেফাজত ছাড়াও ইসলামী ঐক্যজোট, জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ছাত্রশিবির, নেজামে ইসলাম, খেলাফত মজলিস, খেলাফত আন্দোলন, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, বিএনপি, যুবদল ও ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় নেতা-কর্মীদের আসামি করা হয়।

পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র জানায়, মামলায় হেফাজতের কেন্দ্রীয় কমিটির মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরী, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মহাসচিব মুফতি ওয়াক্কাস, বিএনপি-জামায়াতসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় নেতাসহ ৮৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তাঁরা জামিন পান। ৫ মে একজন পুলিশ সদস্য নিহত হওয়ার ঘটনায় বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতা মওদুদ আহমদ, প্রয়াত এম কে আনোয়ার, রফিকুল ইসলাম মিয়াকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।

জুনায়েদ বাবুনগরী প্রথম আলোকে বলেন, সরকার মামলাগুলো ঝুলিয়ে রেখেছে। তাঁরা দীর্ঘদিন ধরে এসব মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে আসছেন। তবে সরকারের সঙ্গে হেফাজতের সমঝোতার ব্যাপারে তিনি কিছু বলেননি।

ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) জানায়, রাজধানীতে করা ৫৩টি মামলার মধ্যে ৪টি মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। বাকি ৪৯টি মামলা তদন্তের পর্যায়ে পড়ে রয়েছে। এসব মামলায় প্রায় আড়াই শ নেতার নামসহ অন্তত ৪০ হাজার লোক আসামি। ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) কৃষ্ণপদ রায় প্রথম আলোকে বলেন, যাচাই-বাছাই করে তদন্ত শেষ করতে সময় বেশি লাগছে।

ঢাকার বাইরের মামলা
ঢাকার ঘটনার পরদিন ৬ মে হেফাজতে ইসলামের ডাকা সড়ক অবরোধে চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে ছয়জন নিহত হন। এ ঘটনায় হাটহাজারী থানার পুলিশ একটি মামলা করে। মামলায় ৫৩ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতনামা চার-পাঁচ হাজার ব্যক্তিকে আসামি করা হয়। আসামিরা সবাই স্থানীয় বিএনপির নেতা-কর্মী এবং হেফাজতের সমর্থক।

হাটহাজারী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. বেলালউদ্দীন আহমদ জাহাঙ্গীর গত রোববার প্রথম আলোকে বলেন, মামলাটির তদন্ত এখনো শেষ হয়নি।

ঢাকার ঘটনাকে কেন্দ্র করে ওই দিন ও পরদিন বাগেরহাটে হেফাজতের কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে হেফাজতের দুজন কর্মী নিহত হন। এ ঘটনায় ফকিরহাটে চারটি ও বাগেরহাট সদর থানায় দুটি মামলা করে পুলিশ। এতে হেফাজত, জামায়াত, স্থানীয় বিএনপির ৮৮ জন নেতা-কর্মীসহ ১০ থেকে ১২ হাজার অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিকে আসামি করা হয়।

বাগেরহাটের জেলা পুলিশ সুপার পঙ্কজ চন্দ্র রায় প্রথম আলোকে বলেন, হেফাজত, জামায়াত ও বিএনপির স্থানীয় নেতা-কর্মীদের আসামি করে ছয়টি মামলায় এর আগে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয়েছে।

নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুর-শিমরাইল এলাকায় হেফাজতের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে পুলিশ-বিজিবির সংঘর্ষ এবং নিহত হওয়ার ঘটনায় সোনারগাঁ ও সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় সাতটি মামলা হয়। নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার মঈনুল হক প্রথম আলোকে বলেন, এর আগে পাঁচ মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। বাকি দুই মামলার তদন্ত এখনো শেষ হয়নি।

এ ছাড়া অন্য চার জেলায় হেফাজতের বিরুদ্ধে করা মামলার তদন্তও থেমে আছে বলে পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল প্রথম আলোকে বলেন, হেফাজত তাণ্ডব চালিয়ে জনজীবন অচল করে দিয়েছিল। যেভাবে তারা সব মানুষকে ভীতসন্ত্রস্ত করেছে, সম্পদের ক্ষতি করেছে, আর্থিক ক্ষতি ঘটিয়েছে, যেসব মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাদের কি বিচার পাওয়ার অধিকার নেই। মামলা প্রত্যাহার করে নেবে এমন হয়তো ইঙ্গিত পেয়েছেন হেফাজত নেতারা। তাঁরা শাস্তির ভয় পান না। তাঁরা মনে করেন, কোনো না কোনো কারণে তাঁরা যে অন্যায় করেছেন, তা মাফ করে দেওয়া হবে।

সুলতানা কামাল বলেন, ‘হেফাজতের সঙ্গে সরকার যে সম্পর্ক স্থাপন করেছে, সেখানে যদি মামলাগুলোর অগ্রগতি হতো, তাহলে হয়তো অবাক হওয়ার ব্যাপার ছিল। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা আমাদের সবচেয়ে উদ্বিগ্ন করে মামলা করেছে রাষ্ট্র, সরকার নয়। সরকারের সঙ্গে কার কী সম্পর্ক, সেটার ওপর নির্ভর করে রাষ্ট্রের করা মামলা এগোবে কেন, সেটাই আমাদের প্রশ্ন।’

Comment here